‘স্পুটনিক-ভি’ হলো করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় টিকা বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচলক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ওষুধ প্রশাসন অফিসে সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, আগামী মে মাসের মধ্যে ৪০ লাখ রাশিয়ান টিকা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো পরীক্ষা ছাড়াই এত তাড়াতাড়ি কিভাবে রাশিয়ান টিকার অনুমোদন দেয়া হলো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্পুটনিক-ভি’ টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিক্যাল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি’।

‘স্পুটনিক-ভি’ হলো করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় টিকা বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার
‘স্পুটনিক-ভি’ হলো করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় টিকা বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার


মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সভায় এ টিকার সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রিপোর্ট, ফেইজ ওয়ান, ফেইজ-টু, ফেইজ থ্রির রিপোর্ট এগুলো ইভাল্যুয়েশন করা হয়েছে।’ ‘আমরা আজ এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিলাম। এখন এটা বাংলাদেশে আমদানি ও ব্যবহারে কোনো বাধা রইল না। আশা করছি মে মাসের মধ্যেই আমরা এই টিকা পেয়ে যাব।’
‘স্পুটনিক-ভি’ হলো করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় টিকা, যা বাংলাদেশে মানুষের ওপর প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হলো।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার।


মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানান, মে মাস থেকে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পাশাপাশি রাশিয়ান টিকাও দেয়া হবে। তবে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছেন তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ওই কোম্পানির টিকাই পাবেন। তাদের রাশিয়ান টিকা দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, রাশিয়ান স্পুটনিক-ভি আমদানি করা হবে সরকারিভাবে। সরকারের একটি কমিটি সরকারি পর্যায়েই যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় আলোচনা করবে এবং কী দামে পাওয়া যাবে তা তারাই নির্ধারণ করবে।
রাশিয়ান টিকার ডোজ সম্বন্ধে তিনি বলেন, স্পুটনিক-ভি দুই ডোজের টিকা। প্রথম ডোজ দেয়ার ২১ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেয়ার পর এই টিকা নেয়া যাবে কি না সে বিষয়ে ‘ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট গ্রুপ’ (এনআইটিইজি) জানাবে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্য অনেক দেশ রাশিয়ার তৈরি করা এই টিকার অনুমোদন দেয়নি। তাহলে বাংলাদেশ কোন ক্যাটাগরিতে এই টিকার অনুমোদন দিয়েছে জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের নিয়ম অনুসারে দেয়া হয়েছে। এই নিয়ম অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমতি না দিলেও আমরা কোনো ওষুধের জরুরি অনুমোদন দিয়ে তা আমদানি করতে পারি।


বাংলাদেশে করোনার টিকা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বাংলাদেশের তিনটি ওষুধ কোম্পানির করোনার টিকা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বার্তা চলছে। বাংলাদেশে পপুলার, ইনসেপ্টা এবং হেলথকেয়ার টিকা তৈরি করতে পারে। ইনসেপ্টা রাশিয়ার সাথে এরই মধ্যে কথাবার্তা শুরু করেছে। তবে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিকেলস রাশিয়ান টিকা কোম্পানির সাথে এ বিষয়ে কথা বলছে। তারা টেকনোলজি ট্রান্সফারের (প্রযুক্তি হস্তান্তর) মাধ্যমে অথবা বাল্ক (বড় কনটেইনারে এনে এখানে শুধু বোতলজাত করা) নিয়ে এসে এখানে তৈরি করা যায় কি না এ দুটো বিষয়েই রাশিয়ানদের সাথে কথা বলছে।


ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক জানান, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, স্পুটনিক ছাড়াও চীনের সিনোফার্ম, আমেরিকার মডার্নার টিকা আনার বিষয়ে চেষ্টা করা হবে। কারণ এখন আমাদের প্রচুর টিকার প্রয়োজন।
সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি টিকা কোভিশিল্ড দিয়েই ফেব্রুয়ারিতে দেশে গণ টিকাদান শুরু হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরবরাহ সঙ্কটে নতুন চালান না পাওয়ায় অন্য উৎস থেকে টিকা আনার জন্য উদ্যোগী হয় সরকার।
এর আগে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক-ভি টিকার এক হাজার ডোজ দেশে আনার অনুমতি দিয়েছিল সরকার। তবে তা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ছিল না।


রাশিয়ার টিকা ‘৯২ শতাংশ কার্যকর’: মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, রাশিয়ার এই টিকাও দুই ডোজ নিতে হয়। প্রথম ডোজ দেয়ার ২১ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ। টিকা সংরক্ষণ করতে হয় ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়। মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি করা ওই টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯১ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, এদের এফিক্যাসি স্ট্যান্ডার্ড ভালো। এই টিকার সেইফটি মার্জিনও ভালো। সার্বিক বিবেচনা করে আমাদের দেশে, সারা বিশ্বে যে মহামারী চলছে সে বিবেচনায় রেখেই আমরা এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছি।’
শুধু স্পুটনিক নয়, আরো কয়েকটি দেশের সাথে টিকা নিয়ে কথা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চীনের সিনোফার্মার টিকার অনুমোদনের ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি। আমরা হয়তো শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারব।’


করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সরকার দেশের ১৩ কোটির বেশি মানুষকে টিকা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে গত নভেম্বরে সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে চুক্তি করে সরকার। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে এই টিকা আসার কথা ছিল চুক্তিতে। তবে জানুয়ারিতে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ, ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালানে ২০ লাখ ডোজ মিলিয়ে ৭০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে আরো ৩২ লাখ ডোজ টিকা।
ভারতে করোনাভাইরাস মহামারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর দেশটি টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশের কেনা বাকি দুই কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা কবে আসবে, তা এখনো নিশ্চিত না।


উল্লেখ্য, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারের হাতে মজুদ থাকা টিকা থেকে ৮৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০ টিকা দেয়া হয়েছে। সরকারের কাছে রয়েছে ১৮ লাখ এক হাজার ৩০০ ডোজ টিকা। সেরাম থেকে কেনা টিকা পেয়েছে ৭০ লাখ ডোজ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া ৩২ লাখসহ মোট এক কোটি দুই লাখ টিকা ছিল। এর বাইরে সেনাবাহিনী ভারতের সেনাপ্রধানের উপহার হিসেবে এক লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। এই টিকা অবশ্য সাধারণের ব্যবহারের জন্য দেয়া হবে না। বর্তমানে প্রথম ডোজ টিকা প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যদিও গতকাল ৩২৫ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে প্রথম ডোজ হিসেবে। সবাইকে দ্বিতীয় টিকা দিতে হলে সরকারকে আরো প্রায় ১৩ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করতে হবে।


দুই সপ্তাহের আগে টিকা আসছে না : এ দিকে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের আগে কোনো দেশ থেকে টিকা আসছে না। গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বাসভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ তথ্য জানান। মাসুদ বিন মোমেন জানান, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা আনার উদ্যোগ চলছে। তবে প্রক্রিয়া শেষে টিকা আসতে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। এর আগে দেশে কোথাও থেকে টিকা আসছে না।


টিকা নিয়ে চীনের উদ্যোগে ছয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষেপররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন যোগ দেন। মঙ্গলবার বেলা ২টায় ভার্চুয়ালি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যোগ দেন। বৈঠক শেষে ড. মোমেনের বাসভবনে সাংবাদিকদের অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব।